চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিওএ) নির্বাচনে স্বৈরাচারের দোসর ও হত্যা মামলার আসামীদের পুনরায় অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় আনতে সবধরনের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকে কমিশন গঠন, মনোনয়ন জমাদান, আইনের ভুল ব্যাখা দিয়ে অসাধুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সদস্যরা।
এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ও দেশের আমদানী-রপ্তানির পণ্য খালাস ও পণ্য বোঝাই কার্যক্রমের মতো স্পর্শকাতর কাজে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত ১৫ বছর ধরে স্বৈরাচারের দোসররা ক্ষমতার দাপটে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ী, বন্দর ব্যবহারকারী ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে জিম্মি করে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস্ অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিওএ) কে তাদের অবৈধ অর্থ উপার্জন, অনিয়ম ও দুর্নীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।
এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেল ও তার সহযোগীরা। রাসেল আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১৮ সাল থেকে একটানা বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান পদ দখলে করে আছেন। একই সঙ্গে তার সহযোগী জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, আসাদ খান, মোস্তাফিজুর রহমান, দস্তগীর, নাহিদ ও জানে আলম গং এবং তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী সহ বিগত সরকারের দলীয় নেতাদের নিয়ে অ্যাসোসিয়েশনকে দলীয়করণ করেন।
যার জন্য গত ২১/০৮/২০২৪ তারিখ চান্দগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলায় (মামলা নং- ১৮/২০২৪) বিএসবিওএ’র চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান (রাসেল) ও কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরকে আসামী করা হয়। যা ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসায়ী সংগঠনের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। ইতিপূর্বে এই ধরনের ঘটনা বিরল।
বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন
৫ আগস্টের পর থেকে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় একদিনের জন্যও কার্যালয়ে আসেনি। গোপনে থেকে তারা পুনরায় অ্যাসোসিয়েশন দখলে নিতে বিতর্কিত স্বৈরাচারের দোসরকে দিয়ে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন ও তিন সদস্যের একটি আপিল বোর্ড গঠন করে সার্কুলেশন জারী করেন। পরবর্তীতে এ কমিশন একদিনের জন্যও অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে আসেননি এবং তিনজনের দুজনকে সাধারণ সদস্যেদের কেউ চিনেনও না। আবার একটি আপীল বোর্ড গঠন করেছে তাদেরকে কেউ চিনেন না। এমনকি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাদের কোন সম্পৃক্ততাও নেই।
মনোনয়ন জমাদানে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতি
নির্বাচন কমিশনের কোন সদস্য অ্যাসোসিয়েশনে উপস্থিত না থেকে শুধুমাত্র একজন কর্মচারীকে দিয়ে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেন। জমাদানের শেষ দিন পর্যন্ত মোট সাতটি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে এবং ঐ কর্মচারী সাতটি মনোনয়নপত্র জমা পড়ার তালিকা তৈরি করে তা ক্লোজ লিখে স্বাক্ষর করে দেন। অথচ পরদিন একটি পত্রিকায় কমিশনের প্রধানের বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয়, মোট ১৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে এবং প্রার্থীর নাম ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করেছে। এটিকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করছেন নির্বাচনের প্রার্থীরা।
আইনের ভুল ব্যাখা দিয়ে অসাধুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাঁয়তারা
নির্বাচনের প্রার্থী এ এইচ এম মনজুর আলম, রফিকুল ইসলাম মোমিন এবং মশিউল আলম স্বপন চার অসাধু প্রতিষ্ঠান গ্রিন এন্টারপ্রাইজের পক্ষে শামসুজ্জামান রাসেল (২০২৩-২৫), বর্তমান প্রার্থী- কামরুজ্জামান লিটন, এন. সি. এন ট্রেডার্সের পক্ষে জসিম উদ্দিন ভূইয়া, বর্তমান প্রার্থী আজিজুল হক, সি. এন্টারপ্রাইজের পক্ষে জানে আলম, বর্তমান প্রার্থী- মো. হরমুজ শাহ বেলাল এবং এন. এস. এ সার্ভিসেসের পক্ষে মো. দস্তগীর, বর্তমান প্রার্থী- মজিবুল বশরের বিরুদ্ধে আইনের ভুল ব্যাখা দিয়ে অসাধুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাঁয়তারা করার অভিযোগ এনে তাদের প্রার্থীতা বাতিলের দাবি জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশন বরাবরে অভিযোগ করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএসবিওএ সংঘঠনটি সরকারের বাণিজ্য সংঘঠন আইন ২০২২ ও উক্ত আইনের ৩০ ধারায় ক্ষমতাবলে সরকার কর্তৃক প্রণিত বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। এরপ্রেক্ষিতে বিগত ২৯/০৯/২০২৫ তারিখে বিএসবিওএ নির্বাচন বোর্ড সকল সদস্যদের প্রতি এক পরিপত্র জারী করেন। উক্ত পরিপত্রের ১৩ নং দফায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, বিএসবিওএ’র নির্বাহী কমিটিতে কোন ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদ শেষে অন্যূন একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে পরবর্তীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। যাহা বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ এর ১৮ (৪) অনুযায়ী যথাযথ। বিএসবিওএ সংগঠনে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একজন ব্যক্তি ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন ও নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে থাকেন।
কিন্তু উল্লেখিত চারটি প্রতিষ্ঠান ইতিপূর্বে বিএসবিওএতে নির্বাহী কমিটিতে থেকে বর্তমান ঘোষিত নির্বাচনে তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অসাধুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাঁয়তারা করছে। অভিযোগে তাদের প্রার্থীতা বাতিল করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
এক প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন
নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপার্থী হিসেবে সরওয়ার হোসেন সাগরের মনোনয়নপত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ নির্বাচনে শুধুমাত্র মালিক পক্ষই প্রার্থী হতে পারেন। আর কোন প্রতিষ্ঠানে বোর্ড অব ডাইরেক্টর ছাড়া কোন শেয়ার হোল্ডার নির্বাচনে প্রাথী হতে চাইলে তাকে অবশ্যই সেই বিষয়ে বোর্ড অব ডাইরেক্টরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সারওয়ার হোসেন সাগর বর্ণালী কর্পোরেশনের বোর্ড অব ডাইরেক্টরের সদস্য নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত তিনি বর্ণালী কর্পোরেশনের শুধুমাত্র ১০০ শেয়ারের মালিকানায় শেয়ার হোল্ডর মাত্র। এক্ষেত্রে সরওয়ার হোসেন সাগরের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্ধিতার জন্য বর্ণালী কর্পোরেশনের বোর্ড অব ডাইরেক্টরের অনুমোদন কিংবা রেজুলেশন মনোয়নপত্রের সাথে দাখিল করতে হয়। কিন্তু তিনি মনোনয়নপত্রের সাথে তা দাখিল করেনি বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এজন্য নির্বাচনের একাধিক প্রার্থীরা সারওয়ার হোসেন সাগরের মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানান।
অভিযোগের বিষয়ে সারওয়ার হোসেন সাগর বলেন, আমি শেয়ার হোল্ডার ডাইরেক্টর। আমি মালিক হোল্ড করছি। আর আমি যে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করছি, আমার একটা বোর্ড অব ডাইরেক্টরর্সের রেজুলেশন অনুযায়ী জমা দিয়েছি। আমরা ৮ জন মিলে বর্ণালীর মালিক। এরমধ্যে বোর্ডে আছেন ৪ জন। সবাই তো আর বোর্ডে থাকেন না।
তিনি বলেন, আমরা চাই একটি সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। নির্বাচনে ভয়ের কিছু নেই। এখানে সবাই সবাইকে চিনে।
জানতে চাইলে মশিউল আলম স্বপন বলেন, মনোয়ন যাচাই বাছাই সভায় নির্বাচনের বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কমিশন কোন সদ্দুত্তর দিতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের আদলে চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠে স্বৈরাচারের দোসররা। তাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।
এ এইচ এম মনজুর আলম বলেন, ৫ আগস্টের হত্যা মামলার আসামীদের যোগসাজশে নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের আশঙ্কা করছি আমরা। স্বৈরাচারের দোসরদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ক্ষোভের দানা বাঁধছে। এই কমিশন বিদায়ী কমিটির নেতারা তাদের নিজেদের নাম ভোটার তালিকা হতে প্রত্যাহার করে অন্য কর্মচারী বা ব্যক্তি বিশেষকে দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে যা বেআইনী ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। অদৃশ্য নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার যে কথা প্রকাশ করেছে এতে আমরা শংকিত।
তিনি বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি, এ অদৃশ্য নির্বাচন কমিশন অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে না এসে মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই না করে বিগত স্বৈরচারী সরকারের কায়দায় ডামি নির্বাচনে ১২ সদস্যের বিনা প্রতিদ্বন্ধিতার একটি নির্বাচন নাটক সাজাতে পারে।
একইভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশন সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, কে কখন মনোনয়ন ফরম জমা দিল তা মূখ্য বিষয় নয়, একটা অবাধ সুষ্ঠ নির্বাচন মূখ্য বিষয়। এদিকে ৫ আগস্টের পর আত্মগোপন থাকায় চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেলের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি
