যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহতাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর,যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর ।
গিবত শব্দের আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা,পরচর্চা করা, দোষারোপ করা, কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা। ইসলামি শরিয়তে গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহ। হাদিসের বর্ণনা, যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ। (মুসলিম)।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তোমরা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না। (সুরা-৪৯ হুজুরাত,আয়াত : ১২)। দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।…অবশ্যই তারা হুতামাতে (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো হুতামা কী ? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয় বেষ্টন করে রাখবে দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে। (সুরা-১০৪ হুমাজা, আয়াত : ১-৯)।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরনিন্দা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। পবিত্র কোরআনে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে ? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
-
তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে ? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন। তিনি বলেন, তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে দোষের কথা বলি, সেটা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে ? উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার ওপর তুহমত ও বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছ। (মুসলিম)।
যদি কেউ কারও ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, ইসলামি দন্ডবিধিতে তাকে ৮০ দোররা (চাবুক) দেওয়া হবে। এরা ফাসিক, পাপী, অপরাধী। শরিয়তের আদালতে এদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয় ; গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না,যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি মাফ করে,তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে
গিবত বা পরনিন্দা ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ। গিবত করা ও গিবত শোনা সমান অপরাধ। অনেকেই পরনিন্দাকে পাপ বা নিষিদ্ধ বলে মনেই করেন না। মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয় ; গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না, যার গিবত করা হয়েছে, সে ব্যক্তি যদি মাফ করে, তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে। একটি কবিরা গুনাহ কাউকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
গিবতের ভয়াবহতার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারি ও মুসলিম) আরেক হাদিসে এসেছে, তোমরা গিবত করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, গিবতের মাঝে তিনটি ক্ষতি রয়েছে : ১. গিবতকারীর দোয়া কবুল হয় না। ২. গিবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না। ৩. আমলনামায় তার পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে।
যখন কেউ আপনার সঙ্গে বসে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে থামতে বলুন, আল্লাহর হুকুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাবধান করুন। আর তাতেও যদি কাজ না হয়, তবে সেখান থেকে সরে আসুন। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন,পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে তামার নখবিশিষ্ট একদল লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে স্বীয় মুখমন্ডলে ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা ? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত ও চোগলখোরি করত। (আবু দাউদ)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন দুনিয়াতে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে, অর্থাৎ গিবত করবে, কিয়ামতের দিন গিবতকারী পচা মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করা হবে। অতঃপর সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিৎকার করতে করতে তা ভক্ষণ করবে। (বুখারি)।
-
কোনো ব্যক্তি জেনার পর তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গিবতকারীকে যার গিবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না। (মুসলিম)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) কে সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেছিলেন,হে আল্লাহর রাসুল ! গিবত কি জেনার চেয়েও মারাত্মক ? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ। কারণ, কোনো ব্যক্তি জেনার পর তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গিবতকারীকে যার গিবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না। (মুসলিম)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, গিবতের কাফফারা হলো তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি এভাবে বলবে, হে আল্লাহ ! তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও। (বায়হাকি)।
দুনিয়াতে গিবতের সবচেয়ে বড় কুফল হচ্ছে-মানুষের মধ্যে একতা নষ্ট হয়, অন্তরে অন্যের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়,ভালোবাসা ও সম্প্রীতি হারিয়ে যায়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, ঘৃণিত এ গোনাহ থেকে নিজকে বিরত রাখা এবং একে-অন্যের কল্যাণ কামনা করা।
হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম (স.) ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো। (সহিহ বুখারি)
যেহেতু গীবত জান্নাতের অন্তরায় জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাই মুমিন-মুসলমানের গীবতমুক্ত থাকা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গীবতমুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন।
সংশোধনের জন্য বলতে চাইলে যার বিষয় শুধু তাকেই বলা যাবে অন্যকে নয়। সমালোচনাকারীকে বিচারের দিনে নিজের নেক আমল দিয়ে এর বিনিময় পরিশোধ করতে হবে। যার সমালোচনা করেছে তার গুনাহ নিয়ে সমালোচনাকারীকে জাহান্নামে যেতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে পরনিন্দা থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমাদের সবাইকে মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।