বিশ্বব্যাপী চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানবকুল ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ক্ষতি সাধন হচ্ছে যা বলা বাহুল্য। বিশ্বজুড়ে অতিবৃষ্টি বায়ু দূষণ ও পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে সারা পৃথিবী আজ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে । এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী অনবদ্য পরিবেশ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এরুই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিবেশ ধ্বংস বা পরিবেশ নিধন পূর্বক যে রিসোর্ট এবং হোটেল মটেল তৈরি হচ্ছে তা অত্র এলাকা তথা বাংলাদেশের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য বিশাল এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে যা অচিরেই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন এবং একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে সকল পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ কেবল সম্যের দাবি।
ইকো-ট্যুরিজম ধারণার মাধ্যমে অত্র এলাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি। জনগণের তথা ভ্রমণ পিয়াসুদের ব্যাপক চাহিদা পুরনে হোটেল, মটেল ও রিসোর্ট তৈরি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যাতে গাছপালা কর্তন, মাটি কর্তন, জলাশয় ভরাট সহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় যা পরিবেশ তথা সার্বিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে । তাই ইকো সংরক্ষণ খুবই সমসাময়িক প্রয়োজনের বিষয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে জলবায়ু ও আবহাওয়া তথা সুষ্ঠু পরিবেশ এর জন্য বনাঞ্চল রয়েছে ১০.৯১৮% যা পরিবেশ ভারসাম্য এর জন্য কমপক্ষে প্রয়োজন ২৫% থেকে ৩০% । তাই পর্যাপ্ত বনাঞ্চলের অভাবে বাংলাদেশ এর পরিবেশ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ ভারসাম্য ভিত্তিক জরিপ মোতাবেক ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে একটি দেশের মোট আয়তনের ৩৩% বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। বলতে গেলে আমাদের দেশে তার তিন ভাগের এক ভাগ ও বনভূমি নেই । ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত বিভিন্নমুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পতিত হচ্ছে ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবার দেখা যাক পার্বত্য চট্টগ্রাম তার নামের সাথে এখানকার ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় বনাঞ্চল কত শতাংশ?উত্তরে আমরা বলতে পারি পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় ৩৩% এরও বেশি বিভিন্ন তথ্য-পত্র মোতাবেক বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের ৪০% পার্বত্য চট্টগ্রামের রয়েছে যা গোটা বাংলাদেশের পরিবেশ ভারসাম্যে ভূমিকা রেখে আসছে।তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ও পরিবেশ রক্ষা করা এখনকার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলায় দিন দিন বেড়েই চলছে পর্যটক ও ভ্রমণ পিয়াসুদের সংখ্যা। বিরাজমান পর্যটকদের বিভিন্ন সমসাময়িক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা ও বিভিন্ন জায়গা দখল করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্ট যা ক্রমবর্ধমান পরিবেশকে খুবিই ক্ষতির সম্মুখীন করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ইকো ট্যুরিজমের এক ব্যাপক বিস্তার লাভ করছে তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায় রাঙ্গামাটি জেলায় ইকো রিজোর্ট এর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫টি বান্দরবন জেলায় ইকো রিসোর্ট ১০ থেকে ১৫ টি, খাগড়াছড়ি জেলায় ইকো রিসোর্ট ৫ থেকে ১০ টি করে ইকো রিসোর্ট বিদ্যমান রয়েছে যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ইকো- ট্যুরিজম বা ইকো রিসোর্ট পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় দ্রুততার সহিত মানুষের কাছে এর চাহিদা অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
পর্যটনের ব্যাপক বিকাশ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ইকো-ট্যুরিজম এর জন্য সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন,এবং সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বিশেষ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ কে প্রাধান্য দিয়ে তা সম্ভব । প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ;পার্বত্য অঞ্চলে ইকো-ট্যুরিজম যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা নিম্ন রূপে ব্যাখ্যা করা যায় এবং নিম্নলিখিত বিষয়ে উপর আলোকপাত করা যায়। ইকো- ট্যুরিজমের উন্নয়নে যে সকল বিষয়গুলা উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে সেগুলো হচ্ছে :
১) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য,ভারসাম্যপূর্ণ বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হবে।
২) বিশ্রামাগার অবস্থান ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গুষ্টির মধ্যে সুসম্পর্কের বিকাশ ঘটবে।
৩) টেকসই উন্নয়ন অনুশীলনের মাধ্যমে যথার্থ উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
৪) অ্যাডভেঞ্চারিজম ট্র্যাকিং এবং হাইকিং এর মত আনন্দদায়ক ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং অত্র পার্বত্য অঞ্চলে যে সকল হ্রদ রয়েছে সে সকল রোদের মাধ্যমে চিত্রকর্ষক ভ্রমণের পরিধির প্রসার ঘটবে ।
৫) বিভিন্ন জীববৈচিত্র্য বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর কৃষ্টি ও কালচার এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী শিক্ষার মান সংরক্ষণ এর মাধ্যমে ইকো ট্যুরিজম মডেল পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সফলতার মুখ দেখবে।
৬) টেকসই উন্নয়নের ধারণায় অবকাঠামোগত টেকসই পর্যটন সৃষ্টি হবে, যেমন: পরিবেশ বান্ধব লজ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ সম্ভব হবে।
৮) বিভিন্নমুখী প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে উপযুক্ত নিরাপত্তা এবং প্রবেশযোগ্যতার বিকাশ ঘটবে।
৯)পর্যটন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন, পরিবার সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন ইস্যুর মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে।
১০)সরকারি ও বেসরকারি খাতের উদ্যোগ ইকো-ট্যুরিজমের উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে এবং ইকো-ট্যুরিজমের এর বিকাশ সাধিত হবে।
ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নে উপরোল্লিখিত বিষয় সমূহ ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ইকো- ট্যুরিজমের সম্ভাবনা সমৃদ্ধি ঘটাতে পারলেই বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল তথা এক দশমাংস পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আত্মসামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পারিপার্শ্বিক উন্নয়নের সুপান হিসেবে কাজ করবে।
বর্তমানে পর্যটকরা যান্ত্রিক ও মানবসৃষ্ট চিত্তাকর্ষক ভ্রমণের উপভোগ্যতার চেয়ে পরিবেশবান্ধব বা ইকো পরিবেশবান্ধব ভ্রমণকে বেশি পছন্দ করেন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, বান্দরবান , খাগড়াছড়ি এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় বাস্ততন্ত্র, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সংস্কৃতির জন্য বেশ পরিচিতি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইকো- ট্যুরিজমের উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ এর ভারসাম্য, পার্বত্য কৃষ্টি কালচার সংরক্ষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ,বিভিন্ন কমিউনিটির জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলেই হয়তো পিছিয়ে থাকা ও পচশাদপদ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হতে পারে।
চলমান —–
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত ইকো- ট্যুরিজম বিষয়ক গবেষক।