
দুনিয়াতেই বেহেশতের বাগান। পৃথিবীতে ফজিলত ও গুরুত্বপূর্ণ যেসব স্থান রয়েছে তার একটি মসজিদে নববী। আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের পক্ষে মানুষকে আহ্বান করার সময় যখন মক্কার কাফের-মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতন সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায় ঠিক তখনি আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন নবীজি (সা.)।
মদিনার প্রাণকেন্দ্র মসজিদে নববী। মসজিদে নববীর ভেতরে একটা বিশেষ জায়গা আছে নাম রিয়াজুল জান্নাত। রিয়াজুল জান্নাত বলতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময়ে তৈরি করা মসজিদের মিম্বর ও হুজরার (নবীর বাসস্থান কিংবা কামরা) মধ্যবর্তী স্থানকে বোঝায়।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন, আমার ঘর (বর্তমান দাফনের স্থান) এবং আমার মিম্বরের মাঝের জায়গা (রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ) জান্নাতের বাগানগুলোর একটি বাগান। আর আমার মিম্বর আমার হাওজের উপর অবস্থিত।
পবিত্র নগরী মদিনার মসজিদে নববীর বর্তমান মেহরাব তথা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সমাধিস্থল সংলগ্ন ডান পাশের স্থানটিই দুনিয়ার জান্নাতের বাগান। হজ, ওমরাহ ও জিয়ারতকারীরা এ স্থানে অবস্থান নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগী করে নিজেদের ধন্য করেন। সুতরাং রওজা বা জান্নাতের বাগান হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)। ইসলামে ফজিলত লাভের উদ্দেশ্য তিন মসজিদে ভ্রমণ করার অনুমোদন আছে।
এর মধ্যে প্রথমটি হলো, সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম বা কাবা শরিফ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, জেরুজালেমের মসজিদ আল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস : ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদ। তৃতীয়টি হলো, মদিনার মসজিদে নববী, মদিনা নবীর শহর একে আরবিতে বলা হয় মদিনাতুন নবী।
আর মদিনার প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদে নববী। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার বরকতের জন্য দোয়া করেছেন এবং একে সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ায় ফজিলত বেশি।
মসজিদে নববীতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক এবং তাঁর জমানার মূল মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানকে নবীজি বেহেশতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলেছেন। মিম্বর ও হুজরাহর মধ্যবর্তী স্থান- এটাই রিয়াজুল জান্নাত। এর আয়তন প্রায় ২২ মিটার দৈর্ঘ্য ১৫ মিটার প্রস্থ। স্থানটি সীমানা দিয়ে ঘিরে রাখা।

এই জায়গায় সবুজ-সাদা রঙের কার্পেট বিছানো আছে। মসজিদের অন্য কার্পেটগুলো লাল রঙের। ভিন্ন রঙের কার্পেট দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না রিয়াজুল জান্নাতের সীমানা। এ স্থানে নামাজ পড়া অতি উত্তম।
রিয়াজুল জান্নাত মসজিদে নববীর মূল কেন্দ্র বিবেচনা করা হয়। জায়গাটি মসজিদে নববীর সব থেকে মঙ্গলজনক জায়গা। তৎপর্য ও মাহাত্ম্যের বিবেচনায় রিয়াজুল জান্নাত হলো, দুনিয়ায় অবস্থিত জান্নাতের বাগানসমূহের একটি।
তাই জিয়ারতকারীরা এখানে নামাজ আদায় ও দোয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন। তবে এখানে পাঠ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় এখানে দোয়া করতেন। তাই দোয়া করাটাই গুরুত্বপূর্ণ আমল। সেটা হতে পারে যে কোনো দোয়া।
রিয়াজুল জান্নাত এটি এমন একটি জায়গা যেখানে দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা কখনো ফিরিয়ে দেন না। যে কারণে জায়গাটি সবসময় লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। মুসলিমরা সবসময় ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এখানে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের চেষ্টা করেন। এখানে একবার নামাজ আদায় বাইরে এক হাজার বার নামাজ আদায়ের সমতুল্য।
রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশের জন্য নারী পুরুষদের আলাদা আলাদা প্রবেশদ্বার রয়েছে। পুরুষদের জন্য স্থানটি সাধারণত তাহাজ্জুদের সময় খোলা হয় পরে আবার সকাল ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে যাওয়া যায়। নারীরা সেখানে যেতে পারেন ফজর, জোহর ও এশার নামাজের পর। রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান সম্পর্কে কয়েকটি ব্যাখ্যা রয়েছে।
ইবনে হাজাম (রা.) বলেন, রিয়াজুল জান্নাতকে জান্নাতের বাগান বলা হয়েছে রূপকভাবে। ওলামায়ে কেরামরা রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মতে এখানে জিকির করলে রহমত ও সৌভাগ্য লাভ করা যায়।
নুরুদ্দিন সামহুদির লেখা অফা আল অফার দ্বিতীয় খন্ডে বর্ণিত রিয়াজুল জান্নাতে ইবাদত বেহেশতের বাগানে পৌঁছায় এই অর্থে ও তা রূপক অর্থবোধক। আল্লাহ এই স্থানটুকু হুবহু বেহেশতে স্থানান্তর করবেন। এই অংশ অন্যান্য জমিনের মতো নয়। পবিত্র স্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন ইবাদতের মাধ্যমে তা আবাদ রাখি।
মসজিদে নববীর ভেতরের রিয়াজুল জান্নাহ বা জান্নাতের বাগানের অংশে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে। সেগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বা খুঁটি বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তৈরি মসজিদে খেজুর গাছের খুঁটিগুলোর স্থলে উসমানী সুলতান আবদুল মাজিদ পাকা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এগুলোর গায়ে মর্মর পাথর বসানো এবং স্বর্ণের কারুকাজ করা। প্রথম কাতারে ৪টি স্তম্ভের লাল পাথরের এবং পার্থক্য করার সুবিধার জন্য সেগুলোর গায়ে নাম লেখা রয়েছে।
উস্তুওয়ানা হান্নানা (সুবাস স্তম্ভ) :
প্রথমদিকে রাসুল (সা.) মিম্বর ছাড়াই খেজুরগাছের একটি কান্ডে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন। পরবর্তী সময়ে জুমার খুতবা দেওয়ার জন্য দুটি সিঁড়ি ও একটি বসার স্থান তৈরি করা হয়। মিম্বরে নববীর ডান পাশে খেজুর গাছের গুঁড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভটি। এতে নিয়মিত সুগন্ধি মাখানো হয় বলে একে সুবাস স্তম্ভ বলা হয়। এটি বর্তমানে স্তম্ভ আকারে আর নেই। একে উস্তুওয়ানা হান্নানাও বলা হয়।
উস্তুওয়ানা সারির :
সারির অর্থ বিছানা। এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তাঁর বিছানা এখানে স্থাপন করা হতো। এ স্তম্ভটি হুজরা শরিফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত সেখানে তাঁর জন্য খেজুরপাতার তৈরি মাদুর এবং একটি বালিশ রাখা হতো। বুখারি শরিফে বর্ণিত আছে রাসুলুল্লাহ (সা.) মধ্যস্থতার জন্য এই স্তম্ভের কাছে বিছানা পেতে বসতেন।
উস্তুওয়ানা উফুদ (প্রতিনিধি স্তম্ভ) :
বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন প্রতিনিধিদল উস্তুওয়ানা উফুদে বসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে কথা বলতেন। এ স্তম্ভও জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরবের বিভিন্ন প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানাতেন। তিনি তাঁদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন ও এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতেন। ফলে বহু গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। এটাকে গণ্যমান্য মজলিশও বলা হয় যেখানে বড় বড় সাহাবায়ে কিরামও বসেছেন। একে প্রতিনিধি স্তম্ভও বলে।
উস্তুওয়ানা আয়েশা (আয়েশা স্তম্ভ) :
নবী করিম (সা.) বলেছেন, আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত। স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা (রা.) তাঁর ভাগনে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) কে সে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর।
উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ) :
হজরত আবু লুবাবা (রা.) থেকে একটি ভুল সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে পাক (সা.) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব।
নবী করিম (সা.) বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হজরত আবু লুবাবা (রা.) এর তওবা কবুল হলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন। এটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত।
মদিনার প্রাণকেন্দ্র মসজিদে নববী :
পবিত্র নগরী মদিনার মসজিদে নববী বর্তমান মেহরাব তথা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সমাধিস্থল সংলগ্ন ডান পাশের স্থানটিই দুনিয়ার জান্নাতের বাগান। হজ, ওমরাহ ও জিয়ারতকারীরা এ স্থানে অবস্থান নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগি করে নিজেদের ধন্য করেন। রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ আদায় হজ কিংবা ওমরাহ পালনের কোনো শর্ত নয়।
অতএব প্রচন্ড ভিড়ের কারণে যদি আপনি সেখানে যেতে ব্যর্থ হন তাতে কোনো অসুবিধা নেই। শুধু দোয়া করুন যেন আপনি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা। দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ এখানে তাড়াহুড়ো করে ধাক্কাধাক্কি করে। এর ফলে অনেক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সবুজ গম্বুজের নিচে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক অবস্থিত।
উল্লেখ্য পবিত্র মসজিদে নববী (সা.) তথা মহানবী (সা.) এর রওজা পাকের দুই পাশেই রয়েছে নবীজির প্রাণপ্রিয় ছিদ্দীক ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা ফারুকে আজম হযরত ওমর (রা.) এর রাওজা শরীফ। আর মদিনার প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদে নববী।
পরিশেষে : আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবীর উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে দুনিয়ার জান্নাতের বাগান (রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ) রিয়াজুল জান্নাত দেখার তাতে ইবাদত বন্দেগী করার ও সকলকে প্রিয় নবী (সা.) এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। আল্লাহ আমাদের সকলকে নূরানী নবীজির (সা.) নূরী রাওজায়ে আকদাস শরীফ জেয়ারতের মাধ্যমে জীবনকে ধন্য করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট