ই-পেপার | মঙ্গলবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিভীষিকাময় কঠিন সময়ে ভারতের সহযোগিতার কথা স্মরণ শেখ হাসিনার

একসময় দিল্লির অভিজাত পান্ডারা রোডের গোপনে বাস করতেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্তানদের নিয়ে অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে সেখানে থাকতেন তিনি।

বিভীষিকাময় সেই কঠিন সময়ে ভারত কীভাবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল, প্রায় পাঁচ দশক পর সেই কথা জানালেন আবেগঘন শেখ হাসিনা।

গত সোমবার চার দিনের সফরে ভারতে যান তিনি। তার আগে সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরবর্তী সময়ের স্মৃতি হাতড়ে অতীতের ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ‘কাহিনি’ প্রকাশ্যে আনলেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে, তুলে ধরলেন ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের গভীরতা।

সাক্ষ্যৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবারের সদস্যদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিল তৎকালীন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।

কিন্তু আমার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া জার্মানিতে থাকতেন বলে তাই আমি স্বামীর কাছে যেতে দেশ ছেড়েছিলাম ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই। সেদিন আমাকে এবং বোন শেখ রেহানাকে বিমানবন্দরে বিদায় দিতে এসেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। সেটিই ছিল পিতামাতাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার শেষ দেখা।

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার স্বামী বিদেশে ছিল, তাই আমি একই বাড়িতে (বাবা-মায়ের সঙ্গে) থাকতাম। তাই সেদিন সবাই আমার বাবা, মা, আমার তিন ভাই, দুই ভাইয়ের নববিবাহিত বধূসহ পরিবারের সকলেই আমাকে ও রেহানাকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে এসেছিল। আর সেই দিনটি ছিল পরিবারের সবাইকে দেখা শেষ দিন।”

  • অশ্রু সজল চোখে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ভারতই প্রথম তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন নয়া দিল্লি আশ্রয় না দিলে হয়তো এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না।

ঠিক তার ১৫ দিন পর ১৫ আগস্ট সকালে, আমি এমন খবর পাই যা আমার বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। আমি জানতে পারি আমার বাবা কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।

“এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। অবিশ্বাস্য যে, কোনো বাঙালি এটা করতে পারে এবং তখনও আমরা জানতাম না কীভাবে, আসলে কী ঘটেছিল। শুধুমাত্র একটি অভ্যুত্থান হয়েছিল এবং তারপর আমরা শুনলাম যে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানতাম না যে, পরিবারের সকল (নিহতদের মধ্যে) সদস্য ছিল।”

অশ্রু সজল চোখে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ভারতই প্রথম তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। হাসিনা বলেছেন, “মিসেস ইন্দিরা গান্ধী অবিলম্বে আমাদের জানিয়েছিলেন, তিনি আমাদের নিরাপত্তা এবং আশ্রয় দিতে চান। যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো এবং মিসেস গান্ধীই প্রথমত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা দিল্লিতে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দিল্লি থেকে আমরা দেশে ফিরতে পারব। জানতে পারব পরিবারের কতজন এখনও বেঁচে আছেন।”

হাসিনা দিল্লিতে ফিরে আসার পর প্রথমে তাঁদের যাবতীয় নিরাপত্তা-সহ একটি বাড়িতে রাখা হয়েছিল। কারণ তাঁদের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

হাসিনার দাবি, “ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ যেন আর ক্ষমতায় না আসে। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর, তারা তাকেও রেহাই দেয়নি। দিল্লিতে ফিরে এসে আমি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমার স্বামীর জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

প্রথম ২-৩ বছর মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন ছিল। নিজের নাম, নিজের পরিচয় ব্যবহার করতে পারতাম না। নিরাপত্তার কারণে আমাদের অনুমতি ছিল না। আমার ছেলের বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর। আমার মেয়ে, সে আরও ছোট। দুজনেই কান্নাকাটি করত। আমার বাবার কাছে যেতে চাইত। আমার ছোট ভাইয়ের কথাই তাদের সবচেয়ে বেশি মনে ছিল।”

পরের ছয় বছর, অর্থাৎ ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আমি ভিন্ন নাম-পরিচয়ে দিল্লিতেই বসবাস করেছি। তবে, বাংলাদেশে অনেকেই চাইছিলেন যে, আমি আওয়ামী লীগ দলের নেতৃত্ব দিই। হাসিনা বলেছেন, “আমি অবশ্যই দেশে ফিরতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু এত বড় দলের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কখনও ভাবিনি। তবে সেই সময় বাংলাদেশে আওয়ামি লীগের একটি বড় সম্মেলন হয়। আমার অনুপস্থিতিতেই, আমাকে দলের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।” এরপরই বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলা।।

তবে তারপরও বহুবার আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। বারবারই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। তবে, সেদিন নয়া দিল্লি আমাকে আশ্রয় না দিলে হয়তো এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না।

তিনিও সম্ভাব্য টার্গেট বলে মনে করেন কিনা এই বিষয়ে হাসিনা বলেন, “যে দুর্বৃত্তরা তার বাবার ওপর হামলা করেছে তারা অন্য আত্মীয়দের বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে এবং তার আত্মীয়দের কয়েকজনকে হত্যা করেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবার ও নিকট আত্মীয় সকলকে হত্যা করা ষড়যন্ত্রকারীদের স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ যেন আর ক্ষমতায় না আসে।”

  • ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। এই বন্ধুত্ব সবসময়ের। আমরা সব সময় মনে রাখি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাদের অবদানের কথা।বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। কাজেই এটি আমাদের অগ্রাধিকারে থাকবে।- শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা বলেন, “তারা শুধু আমার বাবাকে হত্যা করেনি, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেও বদলে দিয়েছে। সব কিছু  শুধু এক রাতে বদলে গেছে এবং সেই খুনিরা আসলে এখনও আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। আমরা সব সময় মনে রাখি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাদের অবদানের কথা। এমনকি ১৯৭৫ সালে যখন আমার পরিবারের সব সদস্যকে হারালাম, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদেরকে ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

আর আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমরা সবসময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বে গুরুত্বারোপ করি। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, এটা শুধু নেতৃত্ব পর্যায়ের জন্য না, এটা জনগণের জন্য। ভারতের মানুষ, প্রধানমন্ত্রী, নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির প্রতি শুভ কামনার পাশাপাশি আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার ওপর। এই সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রপতির প্রতি। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় তারা দুজনেই বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সেই সময় করোনা মহামারি চলছিল। তারপরও তারা এসেছিলেন এবং আমাদের জনগণকে সম্মানিত করেছিলেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব সবসময়ের। বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। কাজেই এটি আমাদের অগ্রাধিকারে থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক