ই-পেপার | মঙ্গলবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলমের সঙ্গে যেভাবে সখ্যতা গড়ে উঠে বিএনপি নেতার

চট্টগ্রামের গন্ডামারায় নির্মিত হয়েছে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সাল। এটির নির্মাণ কাজের শুরুতে বাঁধা দেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদ লেয়াকত আলী। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল লেয়াকতের অনুসারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হলে এতে প্রাণ হারান চারজন। বসতভিটা রক্ষা কমিটির ব্যানারে এ আন্দোলনে নামেন বিএনপি নেতা লেয়াকত।

এদিকে, হতাহতের ঘটনার পরপরই লেয়াকত বাগিয়ে নেয় শিল্পগ্রুপ এস আলম। এক্ষেত্রে সহায়তা করেন নৌবাহিনীর তৎকালীন এক কর্মকর্তা। যিনি তখন কোস্ট গার্ডের দায়িত্বে ছিলেন।

ওই নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে গুম-খুনের জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার হয়।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার লোকজন জানে লেয়াকতের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের সখ্যতার বিষয়টি। কীভাবে বিতর্কিত শিল্পগ্রুপের সহায়তায় রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান লেয়াকত- সেটিও এলাকাবাসীর কাছে ওপেন-সিক্রেট।

বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়, প্রকল্পে শ্রমিকসহ নানা মালামাল সরবরাহ এবং স্ক্র‍্যাপ ব্যবসার সবই ছিল লেয়াকতের নেতৃত্বে। লেয়াকত ও এস আলমের বন্ধুত্বের কারণে আওয়ামী লীগের আমলেও দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরাও কোনঠাসা ছিল। পুরো গন্ডামারায় লেয়াকতের কথাই শেষ কথা ছিল।

লেয়াকতের বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি, পুলিশের ওপর হামলা, দস্যুতা, ভয়ভীতি, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় ২১টির বেশি মামলা রয়েছে। তবে মামলা থাকলে তাকে গ্রেপ্তার করতে ভয় পেতেন পুলিশ কর্মকর্তারা। লেয়াকতের বাসার আশেপাশে সবসময় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লোকজন পাহাড়া দিতেন।

লেয়াকত আলী ২০০৩ সালে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পর পর ২ বার দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন তিনি।

নির্ভরযোগ্য একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে এস আলম গ্রুপ গন্ডামারা ইউনিয়নে জায়গা জমি ক্রয় করে। এরপর লেয়াকত আরেকটি দেশীয় শিল্পগ্রুপকে জায়গা কিনে দেওয়ার নাম করে ওই এলাকা পরিদর্শন করান। পরবর্তীতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

২০১৬ সালে ৪ এপ্রিল কয়লা বিদ্যুৎ নির্মাণে বাঁধা দেয় স্থানীয় লোকজন। এতে ৪ জন নিহত ও শত শত মানুষ আহত হয়। একপর্যায়ে বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনায় এস আলম গ্রুপ লেয়াকত আলীর সমঝোতা করতে বাধ্য হয়।

২০০৯ ও ২০১৪ সালে পর পর ২ বার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করার কারণে লেয়াকত দল থেকে ছিটকে পড়ে। যদিও তখনো কেন্দ্রীয় বিএনপির এক নেতার সঙ্গে লেয়াকতের সখ্যতা ছিল।

ওই নেতার মাধ্যমে দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি বানিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কয়েকজনের কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় লেয়াকত। এর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কৃষকদলের সাবেক সদস্য সচিব আবদুর রশিদ দৌলতি লেয়াকত আলীর বিরুদ্ধে ১৫ লাখ টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা করে। মামলাটিতে লেয়াকত আলী কারাভোগও করেন।

একসময় আর্থিকভাবে তেমন স্বচ্ছল না হলেও ২০১৬ সালের পর এস আলমের সঙ্গে সখ্যতা হলে লেয়াকতকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খুনোখুনির পর সমঝোতার মাধ্যমে গন্ডামারার জায়গা জমি নামমাত্র মূল্যে এস আলমকে মালিক বানিয়ে দিয়ে শত কোটি টাকার মালিক বনে যায় তিনি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্সফেক্ট্রার সঙ্গে ঝামেলা করে এস আলমের ভরাট কাজ থেকে ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন লেয়াকত। এসব টাকা দিয়ে লেয়াকত চেয়ারম্যান নিজে ও তার স্ত্রীর নামে প্রায় ১০০ বিঘা জায়গা ক্রয় করেন।

এদিকে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঋণের নামে এস আলম গ্রুপের নানা ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা প্রকাশিত হতে থাকে। গত ২৯ আগস্ট বিতর্কিত এই শিল্পগ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের পরিবারের ব্যবহৃত ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নিতে সহায়তার অভিযোগ উঠে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মুখে।

এটি নিয়ে ভিডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে বিএনপি ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট বিলুপ্ত ঘোষণা করে।

এর আগে গত ২৮ আগস্ট এস আলমের মালিকানাধীন একটি বিলাসবহুল গাড়িতে চড়তে দেখা গেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে। মিতসুবিশির স্টেশন ওয়াগন ব্র্যান্ডের জিপে করে ওইদিন তিনি কক্সবাজার থেকে চকরিয়া-পেকুয়ায় যান। বহর নিয়ে সালাউদ্দিনের যাত্রার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চান বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন।

সবশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার জামালখান এলাকার একটি ভবনের পার্কিং থেকে এস আলমের মালিকানাধীন একটি গাড়ি জব্দ করে পুলিশ। ওই ভবনের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন নগরের কোতোয়ালি থানা বিএনপির সভাপতি মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী। যদিও এস আলমের গাড়িটি কীভাবে তার ভবনের পার্কিংয়ে রাখা হয়েছে- সেটি তিনি নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন।

এসব নিয়ে ডামাডোলের মধ্যেই এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদের সঙ্গে লেয়াকত আলীর সখ্যতার একাধিক ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাঁশখালীর লোকজন এসব ছবি শেয়ার করে লেয়াকত চেয়ারম্যানের শাস্তি দাবি করেন।

এস আলমের সঙ্গে লেয়াকতের সখ্যতার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দক্ষিণ জেলা বিএনপির বিলুপ্ত হওয়া কমিটির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান।

অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতা লেয়াকত আলী বলেন, আম যেটা পাকা, সেটিতে সবাই ঢিল ছুড়ে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমি সম্মুখভাগে ছিলাম। একারণে দল আমাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করছে। এটি অনেকেই সহ্য করছে না। একারণে হয়তো আমার পেছনে লেগেছে। আওয়ামী লীগের আমলে অনেকেই সুবিধা নিয়েছেন। স্বৈরাচারের দোসরদের সঙ্গে তারাও এ অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।

গত ২৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‌গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এস আলম বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন।

এভাবে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কি না জানা নেই। এখন এস আলমের নামে–বেনামে থাকা সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। তাই এই মুহূর্তে এস আলমের সম্পদ যেন কেউ না কেনেন।