-
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোটি কোটি ঘুষের টাকা হাউস থেকে নিরাপদে সরানোর জন্য বহিরাগত দালালদেরও নিজস্ব দালাল আছে।
-
দালালদের অধিকাংশই কাস্টম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীয়-স্বজন।
-
আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিতে এদের মধ্যে অনেকের আছে কাস্টমস সরকার লাইসেন্স।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ বহিরাগত প্রায় ১৫০ জন দালাল রেখে হাজার কোটি ঘুষের টাকা সংগ্রহ করেন। কাস্টমসের প্রত্যেক গ্রুপ বা সেকশনে ন্যূনতম সাত থেকে আট জন কিংবা তার চেয়েও বেশি বহিরাগত দালাল কাজ করেন। দালালদের অধিকাংশই কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীর আত্মীয়-স্বজন। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিতে এদের মধ্যে অনেকের আছে কাস্টমস সরকার লাইসেন্স।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষের টাকা হাউস থেকে নিরাপদ সরানোর জন্য বহিরাগত দালালরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণের তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম কাস্টমসের কাস্টম সরকার মোহাম্মদ ফয়সাল মাহমুদ, নিজাম চন্দ্র দাস, শাহরিয়ার শাকিল ও নিকুঞ্জু সরকার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়ে চট্টগ্রামে কাস্টমসের বিভিন্ন গ্রæপে বা সেকশনে অবৈধ বহিরাগত দালাল প্রত্যাহারপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য আবেদন জানানো হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারে আমলে চট্টগ্রাম কাস্টমসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অবৈধ বহিরাগত দালালদেরকে সরকারি দপ্তরে অবৈধভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। দালালদের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ গ্রহণ করে। কাস্টমসের প্রত্যেক গ্রুপে বা সেকশনে ৭ থেকে ৮ জন অবৈধ বহিরাগত লোক কাজ করে।
দেখা যায়, দালালরা নিজেও অবৈধ বহিরাগত লোক রাখে ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে কাস্টম হাউস থেকে নিরাপদে সরানোর জন্য।
এতে আরও বলা হয়, কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটি নথি বা ফোল্ডারের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ এবং কত লাখ টাকা শুল্ক-করাদি ফাঁকি হলো, তার উপর দুইগুণ জরিমানা হিসাব করে তার অর্ধেক টাকা ঘুষ দাবি করে। এই ঘুষের টাকা অবৈধ বহিরাগত দালালের মাধ্যমে গ্রহণ করে।
একই সাথে ঘুষের টাকা ব্যাগে করে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাসাতে পৌঁছিয়ে দেন। এছাড়া কাস্টমস থেকে দালাল প্রত্যাহারপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা করা হলে ঘুষ প্রথা বন্ধ হয়ে যাবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধিসহ দেশ ও দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠির সঙ্গে অবৈধ বহিরাগত দালাল চক্রের ১১ পৃষ্ঠার একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়। তালিকায় ১৪০ জন দালালের নাম, কাজের বিবরণ, শাখা ও মোবাইল নাম্বার এবং এসব দালাল কাস্টমসের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারির আওতাধীন রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়।
এদের মধ্যে রয়েছে- সেকশন-৯(বি)- মো. রাসেল গাজী, মো. আনোয়ার, মনছুর আলম, মো. সানজু ও মো. নাজিম। সেকশন-৯(এ/সি)- মো. জুয়েল, মো. ফাহিম, আবুল হোসেন, মো. রাজু, আশিক ও মো. জমির। সেকশন-২- মামুনুল হক সানি, মো. আলী আহমদ, মো. মারুফ, মো. সাদ্দাম হোসেন। সেকশন-৩- মো. আরিফ, মো. মিনহাজ, মো. মহেদি, আব্দুর রহিম, মো. পাভেল, মো. রনি, মো. মামুন। সেকশন-৪- মো. আবু তাহের (টুপি মিজান), মো. শাহ আলম, মো. সোহাগ, মো. আরমান, মো. শুভ, মো. জিরান ও মো. জাহাঙ্গীর। সেকশন-৬- মো. পাপ্পু, রতন ও মোয়াজ্জেম হোসেন। সেকশন-৮(এ)- মো. মনোয়ার, মো. নোমান, আরমান রেজা, মো. রানা, মো. কুদ্দুস ও মো. মঞ্জুর। সেকশন৫-(এ)- মো. রোকন, মো. ইব্রাহীম, মো. সম্রাট, আব্দুল হাসনাত, মো. বিল্লাল ও আয়াত। সেকশন-৫(বি)- মো. নাছির ও মো. জুয়েল। সেকশন-৭(এ)- সাইফুল শাহিন, মো. সুমন ও নাছির। সেকশন-৭(বি)- মো. আজিজ ও মো. সাব্বির। সেকশন-৮(বি)- মো. ছিয়াম ও মহিউদ্দিন রুবেল। সেকশন-৮(সি)- মো. সেলিম ও করিম মিয়া। সেকশন-৮(ডি)- কবির হোসেন ও কৃষ্ণ। লাইসেন্স শাখা- মো. শামীম, মো. দিদার, শামীম, মো. রাজু ও জামাই। পিসিএ শাখা-মো. রিয়াদ ও মেহেরাজ। এআইআর শাখা-মো. নবী, মো. ফয়সাল, মেহেরাজ ও জাহিদ। সাবটিম-১৬- মো. ফয়সাল। সাবটিম-১৫- মো. শিহাব। সাবটিম-১৪- মো. আলামিন ও মো. সোহেল। সাবটিম-১৩- মো. নাজির। সাবটিম-১২-মো. রাসেল ও মো. জাকির। যোগাযোগ শাখা- মো. ঈমন, মো. রাসেল ও লিটনের ভাই মিটন। প্রশাসন শাখা- ডালিম, প্রণব ও আমির হোসেন। স্টাফ শাখা- মো. আলম, মো. রাসেল,জসিম উদ্দিন ও মো. হেলাল। ট্রেজারি শাখা- মো. আলাউদ্দিন, মো. মুন্না ও মো. হাফিজুর রহমান। আইজিএম শাখা- মো. রাজু। রপ্তানি শাখা-হুমায়ুন কবির। এডব্লিও সার্ভার শাখা- মো. নাঈম। সেকশন-১(এ)- মো. জাহাঙ্গীর ও মো. রাজ। সেকশন-১(বি)-রাজু ও মিন্টু। আইন শাখা- মো. নয়ন। রাসায়নিক শাখা-সিরাজুল ইসলাম রাজু ও দেলোয়ার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পিওনের সাথে এবং অন্যান্য- মো. শাওন, হান্নান, বিকাশ, শাহজাহান, রশিদ, মুরাদ, মো. ফরাদ, মো. ফাহিম, মো. নাহিদ, আব্দুর সাত্তার, ইউছুফ, মো. আফসার, বাহাদুর শাহ, মো. জীবন, মো. জুয়েল, মো. শাহিন, মো. সানজিব, মো. নুরুদ্দিন, আলী হোসেন, মো. নয়ন, মোফাজ্জল হোসেন, মো. বিপুল, মো. মিলন, মোস্তফা ও মো. ইলিয়াস।
কাস্টম সরকাররা জানান, কাস্টমসের প্রত্যেকটি সেকশনে ন্যূনতম ৭ থেকে ৮ জন অথবা তার চেয়েও বেশি দালাল কাজ করে। যেমন- শাখা সহকারীরা দালাল রাখে ২ জন, কম্পিউটার অপারেটর রাখে ১ জন, ৪ জন এআরও সাথে রাখে ২ জন, আরও সাথে রাখে ১ জন এবং সিপাই বা অফিস সহায়করা ২ জন দালাল রাখে।
এসব দালালদের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাজার কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করে। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাকে ফাঁকি দিতে এদের মধ্যে অনেকের আছে কাস্টমস সরকার লাইসেন্স। এদেরকে ধরে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করে তার তথ্য পাওয়া যাবেও জানান তারা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার এইচ এম কবির বলেন, কাস্টমসের অভ্যন্তরে প্রত্যেকটা জায়গায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রবেশ গেটে সবার আইডি কার্ড চেক করা হচ্ছে। এদেরকে দেখা মাত্রই পুলিম কিংবা আমাদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
