একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়নে, বহুল প্রতীক্ষিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু, যা “মৈত্রী সেতু” নামে পরিচিত, এটি বাণিজ্য ও যোগাযোগের নতুন পথ উন্মোচন করার জন্য প্রস্তুত। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হচ্ছে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত ‘মৈত্রী সেতু’। অফিসিয়াল সূত্রের বরাত দিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে প্রস্তাবিত সফরের সময় নয়াদিল্লি থেকে ভার্চুয়ালি সাব্রুম চেকপয়েন্ট খোলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের সম্ভাবনা রয়েছে।
একইভাবে গত ৮ আগস্ট সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা। সাক্ষাতের পরে তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ১৭ তম জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এ সফরের আগে ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’ দিয়ে যাত্রী চলাচল শুরু করতে চান। সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
-
দুই দেশের পণ্য পরিবহনের খরচ ও সময় কমার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি, পর্যটনখাতের বিকাশসহ দুই দেশের লোকজনের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হবে
জানা যায়, সেতুর পাশাপাশি রামগড়ে চালু হতে যাচ্ছে স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন। এতে পার্বত্য অঞ্চলসহ চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মানুষ সহজেই ভারতে যাতায়াত করতে পারবেন। আর দুই দেশের পণ্য পরিবহনের খরচ ও সময় কমার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি, পর্যটনখাতের বিকাশসহ দুই দেশের লোকজনের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হবে।
‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’ এর একপাশে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় অপর পাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম অঞ্চল। সেতুটির নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। মূল সেতুর মুখেই বিজিবির নিরাপত্তা চেকপোস্ট। সেতুর মোট ১০টি পিলারের মধ্যে তিনটি বাংলাদেশ ও ৭টি বসানো হয়েছে ভারতের অংশে। বাংলাদেশ অংশে ইমিগ্রেশন ভবনের কাজও শেষ। ভারত অংশেও বিএসএফের নিরাপত্তা চেকপোস্ট রাখা হয়েছে। ইমিগ্রেশন ভবনের আগে সড়কে বসানো হয়েছে পণ্যবাহী ট্রাকের ওজন মাপার স্কেল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে অবকাঠামোগত সব কাজই সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পর প্রথমে মানুষের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এরপর শুরু হবে পণ্য আমদানি-রফতানি।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’ এর দৈর্ঘ্য ৪১২ মিটার, প্রস্থ ১৪ দশমিক ৫ মিটার এবং ডাবল লাইনযুক্ত। সেতুটিতে মোট ১০টি পিলার। পূর্বপ্রান্তে বাংলাদেশ অংশে ১৪০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে রামগড় স্থলবন্দর। এ সেতু থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ফলে সেতুটি চালু হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব কমে আসবে, বাড়বে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’ এর ভিত্তিপ্রস্তর ফলক উন্মোচন করেন। ৮ বছরের বেশি সময় পর সেতুটির সব কাজ শেষ হয়।
‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’ চালু হলে বাংলাদেশ অংশে রামগড়-বারৈয়ারহাট গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। আর ভারতের অংশে প্রায় ১২০০ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক নবীনপাড়া-ঠাকুরপল্লী হয়ে সাব্রুম-আগরতলা জাতীয় সড়কে যুক্ত হবে।
সেতুটি চালু হলে রামগড় বন্দর দিয়ে ভারত সমুদ্রপথে বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য চলে যাবে ভারতের সাত রাজ্যে। এতে বাংলাদেশ পাবে রাজস্ব সুবিধা। আর কম সময়ে স্থলবন্দর হয়ে আগরতলা বিমানবন্দর দিয়ে ভারত যেতে পারবেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ।
-
কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে ত্রিপুরা হয়ে ভারতে এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক কার্গো যাতায়াতের সুবিধা দেবে মৈত্রী সেতু।
ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম, আসাম, মিজোরাম ও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির রামগড়, মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, মিরসরাই, সীতাকুণ্ডসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মানুষ যাতায়াত সুবিধার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
এদিকে গত ১৬ আগস্ট সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের কনফারেন্স হলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা আহ্বান করা হয়েছিল, সেখানে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাজু ওয়াহিদ বলেন, তৃতীয় চেকপয়েন্টটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগের নতুন পথ উন্মোচন করবে। ল্যান্ডপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, বিএসএফ, স্টেট ইলেকট্রিসিটি কর্পোরেশন এবং স্যানিটেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় পর্যালোচনার জন্য উল্লিখিত এলাকা পরিদর্শনের পর একটি বৈঠক করেন তিনি।
সাজু ওয়াহিদ বলেন, আমরা ১ সেপ্টেম্বর থেকে আন্তঃসীমান্ত চলাচলের সুবিধার্থে মৈত্রী সেতুতে একটি ইমিগ্রেশন কাউন্টার খোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। প্রাথমিকভাবে, এতে কোনো পণ্যবাহী যান চলাচল করবে না। মৈত্রী সেতু ব্যবহার করে সাব্রুম দিয়ে যাত্রীরা চলাচল করতে পারবেন। ধীরে ধীরে এ রাস্তাটি স্থিতিশীল হয়ে উঠলে এবং পরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে স্থাপন করার পর পণ্য ও কার্গো চলাচল শুরু হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতীয় অংশে বিএসএফের ১২৬ ব্যাটালিয়ন এবং বাংলাদেশ অংশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ৯৬ ব্যাটালিয়ন যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেবে। কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে ত্রিপুরা হয়ে ভারতে এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক কার্গো যাতায়াতের সুবিধা দেবে মৈত্রী সেতু।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২১ সালের মার্চ মাসে তার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘মৈত্রী সেতু’ উদ্বোধন করেন।
লেখক- সাংবাদিক