অত্যধিক গরম মোকাবিলায় এসিই কি কেবল বিকল্প হতে পারে? চলুন, এই জবাবে ‘না’ বলে দিই সরাসরি। এরপর ঘুরে আসি সোনালী অতীতে। এই কয়েক দশক আগে মাত্র। তখনো কাঁঠফাটা গ্রীষ্ম নামতো, তখনো তালপাকা ভাদ্র আসতো। যদিও জলবায়ুর এমন খামখেয়ালিপনা কম ছিল তখনকার দিনে।
আচ্ছা, ওই সময়টায় গরমের তাপদাপ মোকাবিলায় মানুষ কি করতো! আসলে তখন বৃক্ষছায়া গরমের বিরদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়াতো, তখন ঘাসের আচ্ছাদন গরম তাড়াতো। তখন চারপাশে সবুজ প্রতিবেশ পাওয়া যেতো। এমনকি দরজায়-জানালায় গাছ কিংবা ঘাসের ভুরি ভুরি উপস্থিতি মিলতো। এতে অক্সিজেন সরবরাহের পাশাপাশি পরিবেশের শীতলীকরণও ঘটে যেতো নিরবে।
আসলে গরমের সময় ঠান্ডা বাড়ি তিংবা ভবন আমরা সবাই চাই ৷ তবে এর জন্য অনেক জ্বালানি প্রয়োজন হয়। আর ওই জ্বালানিই পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দেয়। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে কি আরামে থাকা সম্ভব? কার্বন নির্গমনের একটি বড় উৎস নির্মাণ শিল্প৷ তাই পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ভবন নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন স্থপতিরা।
সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা ডয়চ ভেলে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার কাছে এমন একটি স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে এসি নেই৷ পাহোয়া নামের ওই স্কুলের স্থপতি আদি পুর্নমো বলেন, ‘‘স্কুল ও অন্যান্য সরকারি ভবনের মতো জায়গায় এসি অনেক বেশি জ্বালানি খরচ করে৷ এসব ভবনে বাতাস ও আলোর ব্যবস্থা করা একটা চ্যালেঞ্জ৷”
প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, ‘যে পদ্ধতিতে এমন ভবন নির্মাণ করা যায় তার নাম ‘প্যাসিভ ডিজাইন’৷ এর মাধ্যমে বিদ্যুতের সাহায্যে ভবন আলোকিত ও ঠান্ড না করে প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়৷ এই পদ্ধতিতে অনেক জ্বালানি বাঁচানো সম্ভব৷ নির্মাণ খাতের জন্য এই পদ্ধতি খুব দরকার বলে মনে করেন ইন্দোনেশিয়ার গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের প্রধান আইওয়ান প্রিজানতো৷
তিনি জানান, ‘‘বিশ্বে যত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমন হয় তার প্রায় ৩৯ শতাংশের জন্য দায়ী নির্মাণ শিল্প৷ ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এই খাতই সবচেয়ে বেশি দায়ী, ভবিষ্যতে যা আরো বাড়বে৷” নির্মাণ শিল্পে গ্রিন কনসেপ্ট ধারণার সমর্থক স্থপতি আদি পুর্নমো৷ তার কাজে বায়ু চলাচল ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ বাতাসের দিক বিবেচনায় নিয়ে তিনি ভবনের লেআউট ঠিক করেন৷ আদি পুর্নমো বলেন, ‘‘সূর্যের আলো ও বাতাস চলাচলের পথ জানার চেষ্টা করতে হয়, যা সবসময় পূর্বমুখী ও পশ্চিমমুখী হয়ে থাকে৷ সে কারণে শ্রেণিকক্ষগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে তৈরি করা হয়৷ ফলে জানালা খুললেও নকশার কারণে ক্লাসরুমগুলো গরম হয় না৷” যখন বাতাস থাকে না তখন স্কুলে কম ওয়াটের ফ্যান ব্যবহার করা হয়৷
এছাড়া স্কুলের দেয়ালে লাগানো গাছপালা ভবন ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে৷ আর ছাদে থাকা সবুজ ঘাসের কারণেও নীচের ক্লাসরুম ঠান্ডা থাকে৷ প্রতিটি ব্যবস্থার কারণে এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের পার্থক্য হয়৷ ছাদে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যে, সেখান থেকে প্রাকৃতিক আলো ভবনের নীচ তলা পর্যন্ত পৌঁছায়৷ থেরেসিয়া মারেটা পাহোয়া স্কুলের প্রকল্প পরিচালক৷ তার লক্ষ্য, শিক্ষার্থীদের সারাক্ষণ শীতলীকরণ পরিবেশে না রেখে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ানোর চেষ্টা করা৷
তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে স্কুলে এয়ার কন্ডিশন না রাখার সিদ্ধান্তে অনেকে শক্ত বিরোধিতা করেছিলেন৷ তারা বলতেন তাদের বাচ্চারা নিয়মিত ঘামছে৷ এছাড়া একটা মর্যাদারও প্রশ্ন ছিল৷ হ্যাঁ, আমার সন্তান যে হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছে সেখানে এসি ছিল৷ এরপর যখন হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে গেল সেখানেও এসি ছিল৷ আর এখন এমন স্কুলে যাচ্ছে যেখানে এসি নেই৷”
ইন্দোনেশিয়ার যে কোনো স্কুলের চেয়ে এখন ঐ স্কুলে বর্গমিটার প্রতি জ্বালানির ব্যবহার প্রায় ৫০ শতাংশ কম৷ আদি পুর্নমো বলেন, ‘‘আসলে এটা এমন একটা মডেল যেটা দেখাচ্ছে, সবুজ ভবন মানেই যে ব্যয়বহুল হতে হবে, তা নয়৷ এখানে দেখা যাচ্ছে, খুব সাধারণ নকশা দিয়েই এমন ভবন তৈরি সম্ভব৷”
কোনো ভবনের জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণে প্রভাব রাখতে পারে নকশা৷ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়ও এই স্কুল অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে৷
সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিবেশকে ভালোবেসেই অনেকে লতানো গাছের চারা বসান বাড়িতে। এসব লতানো গাছ তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। এটাকে বলা হয় ‘গ্রিন ওয়াল’ (Green Wall)।
যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাসটেইনেবিলিটি হাবের গবেষকদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের তথ্য। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি সমীক্ষা ও গবেষণা প্রকাশ হয়েছে বিল্ডিং অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে।
১৯৭০-এর দশকের আগে নির্মিত বিভিন্ন বাড়ির ওপর একটি বিশেষ সমীক্ষা চালিয়েছিলেন ব্রিটিশ গবেষকরা। প্রতিটি বাড়ির মূল পরিকাঠামো প্রায় একইরকম। ইট এবং কংক্রিট দিয়ে নির্মিত তাদের প্রচীর। দীর্ঘ পাঁচ সপ্তাহ ধরে বাড়িগুলোতে সূর্যের তাপশোষণের হার এবং তাপমাত্রার পরিমাপ নেন গবেষকরা। তাতেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে তাপ নিয়ন্ত্রণে ‘গ্রিন ওয়াল’-এর ভূমিকা।
গবেষণায় দেখা যায়, গ্রিন ওয়াল যুক্ত বাড়িগুলোতে প্রায় ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ কম তাপ শোষিত হয়েছে। পাশাপাশি এই বাড়িগুলোতে সারাদিনের গড় উষ্ণতাও আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা কম। বিশেষত, দিনের বেলায় তাপপ্রবাহকে বিশেষভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম এই ধরনের দেয়াল।
পরিসংখ্যান বলছে যুক্তরাজ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১৭ শতাংশের জন্য দায়ী সেখানকার বাড়ির শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা এয়ার কন্ডিশন মেশিন। সেখানে দেখতে গেলে শুধু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণই নয়, গ্রিন ওয়ালের সৌজন্যে পরিবেশে বৃদ্ধি পায় অক্সিজেনের মাত্রা। শোষিত হয় কার্বন ডাই অক্সাইড। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবেশকে সুস্থ করে তোলে সবুজ দেয়াল।
বিজ্ঞান সাময়িকী অ্যাটমস্ফেরিক এনভায়রনমেন্টে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শহরাঞ্চলে বড় বড় ইমরাতের ফাঁকে বা রাস্তার পাশে লতাগুল্মের দেয়ালগুলো গাছের চেয়ে ভালো দূষণ প্রতিরোধক। বিজ্ঞানীরা বলছেন, লতা-গুল্মের দেয়াল বাতাসে ভেসে থাকা বিষাক্ত উপাদান শোষণ করে মানুষকে সরাসরি বায়ুদূষণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাতাসের দূষণকারী উপাদান শুষে নিতে এই লতা-গুল্মের দেয়ালগুলো গাছের চেয়ে ভালো কাজ করে। তবে গবেষকরা উন্মুক্ত স্থানে গাছ লাগানোকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশে ভার্টিকেল গার্ডেনের এই সবুজ দেয়াল ব্যাপক জনপ্রিয়। ভবনের ইট-সিমেন্টে বা ইস্পাতের নির্মিত দেয়ালের পরিবর্তে এটি তৈরি হয় গাছ দিয়ে। ল্যান্ডস্কেপিং ও ভবনের বিভিন্ন স্থানে বাগান তৈরির মাধ্যমে ভবন ও আশপাশেও সবুজায়ন ঘটানো যায়। বিভিন্ন গবেষণা দেখা গেছে, গাছের নরম পাতাগুলো সহজেই কম্পন হওয়ায় শব্দতরঙ্গকে বাধা দেয় মেটাল বা কংক্রিটের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। গাছের শরীরে বা পাতার খসখসে অংশে কিংবা পত্ররন্ধ্রে ধূলিকণা আটকে পড়ে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া গাড়ির কালো ধোঁয়াও শুষে নেয় সবুজ প্রকৃতি, তার দেহজুড়ে জায়গা মেলে কার্বন পার্টিকেলের।
ঘরের ভেতরে, লিভিং রুম বা অফিসেও চাইলে ছায়াবান্ধব পাতাবাহারি গাছ দিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেন তৈরি করা যায়। মানিপ্ল্যান্ট, এলোকেশিয়া, ফার্ন, স্পাইডার, লিলি, এনথোরিয়াম, বোট লিলি, ড্রাসেনা, মেরেন্টা, মনস্টেরা ইত্যাদি গাছ দিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেন করে অফিস বা বাসাবাড়ির ভেতরের দেয়ালগুলো নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তোলা যায়। ইদানীং বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্লাস্টিক, লোহা, স্টিল বা কাঠের ফ্রেম বানিয়ে দেয়ালে সেট করে তাতে পোর্টেবল টব ঝুলিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেন তৈরি করা হচ্ছে।
পাশাপাশি দেয়ালের ধাপে ধাপে সিমেন্টের স্থায়ী বেড বানিয়েও ভার্টিক্যাল গার্ডেন করা যায়। আবার দেশীয় প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশ, কাঠ ও রডের মতো সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে তুলনামূলক কম খরচেও ভার্টিক্যাল গার্ডেন করা সম্ভব। ভার্টিক্যাল গার্ডেনে যেহেতু পরিচিত ও দেশীয় সহজলভ্য গাছগুলোই রোপণ করা হয়, তাই এর যতœ ও পরিচর্যা-পদ্ধতি খুব একটা জটিল নয়। পরিমিত পানি ও প্রতি এক-দুই মাস অন্তর পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, সার, ভিটামিন সরবরাহ করলেই গার্ডেন সবুজ ও সতেজ থাকে। এ ছাড়া অটোমেটিক ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেম চালু করে তার সঙ্গে টাইমার কিংবা সেন্সর সেট করে সঠিক পানি-ব্যবস্থাপনা করা যায় ভার্টিক্যাল গার্ডেনে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা আগামী ৫০ বছরে পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে, আর তখন একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে এই ধরণীতে। পানির স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি বরফে পরিণত হয়। আগামী ৫০ বছরে যখন বিশ্বের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে তখন পৃথিবীপৃষ্ঠের যেখানে ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার বরফ আছে তা সবই গলে পানি হয়ে যাবে এবং বিপুল পরিমাণ পানি সমুদ্রে চলে আসবে ।
এভাবে সমুদ্রের তল বেড়ে গিয়ে নদীগুলিতে উল্টোমুখি স্রোত তৈরী হবে এবং ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নদীর দু’কুল উপচিয়ে জমির মাটি লবণাক্ততা হয়ে উর্বরতা হারাবে। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপকূল অঞ্চলগুলি ডুবে যাবে। এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, খরা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি আমাদের দুয়ারে হাজির।
আধুনিক ও নান্দনিক ডিজাইন এবং রঙের চাকচিক্য আমাদের আকৃষ্ট করলেও সবুজের দেখা তেমন নেই। তবে চাইলেই বাড়ি বা ভবনগুলোকে খুব সহজেই সবুজে রূপান্তরিত করতে পারি। তাই ঘরে-বাইরের দেয়াল, বাসার সম্মুখভাগে খোলা পরিসর, বারান্দা-এসব ছোট্ট জায়গায় বাগান সৃজন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অল্প জায়গায় অধিক গাছ রোপণ করে বাড়ির দেয়ালটিকেও সবুজের স্নিগ্ধতায় ঢেকে দেওয়া যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ গৃহস্থলি সংক্রান্ত কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সবুজ ভবন ও সবুজ দেয়াল তৈরি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগেই এজন্য বলে গেছেন,
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান।”
লেখক : উপ-পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।